আচিক নিউজ ডেস্ক : টাঙ্গাইলের মধুপুরে জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে স্থানীয় আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ-ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বনবিভাগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে মধুপুর গড়াঞ্চলের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী জনতা। আজ ২৫ জানুয়ারী, সোমবার বেলা ১১টায় মধুপুর বাসস্টেন্ড আনারস চত্বরে হাজারো আদিবাসী, অ-আদিবাসী নারী-পুরুষ এবং জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, বাগাছাস, জিএসএফ, গাসু, আজিয়া, আচিক মিচিক সোসাইটি, কোচ সম্প্রদায়, টিডব্লিউটিএসহ বিভিন্ন সংগঠন এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
এর আগে রানী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে সমবেত আদিবাসীরা ‘খা সাংমা, খা মারাক’, পীরেন তোমায় ভুলিনাই রাজপথ ছাড়িনাই’, ‘বন বিভাগের দালালেরা হুশিয়ার সাবধান’, ‘পীরেনের রক্ত বৃথা যেতে দিবোনা’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে আনারস চত্বরে সমবেত হন। মধুপুর গড়াঞ্চলের সংক্ষুব্ধ আদিবাসী জনগনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশ সঞ্চালনা করেন বাগাছাস কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি জন যেত্রা ও সভাপতিত্ব করেন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক।
বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ আদিবাসী নেতা ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ, টিডব্লিউএ মধুপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান উইলিয়াম দাজেল, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, ৯ নং অরণখোলা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম, আচিক মিচিক সোসাইটির সভাপতি ও নারী নেত্রী সুলেখা ম্রং, কোচ আদিবাসী নেতা গৌরাঙ্গ বর্মন, আবিমা গারো ইয়ুথ এসোসিয়েশন (আজিয়া)র সদস্য সচিব শ্যামল মানখিন, জিএসএফ কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল, বাগাছাস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি লিংকন দিব্রা, গাসু মধুপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ইব্রিয় মানখিন প্রমূখ।
উক্ত মানববন্ধনে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, মধুপুর গড়াঞ্চলে শতশত বছর ধরে আদিবাসীদের বসবাস কিন্তু বনবিভাগ কয়দিন পরপর আদিবাসীদের নিজ ভূমি উচ্ছেদ করার নোটিশ প্রদান করে।আমরা মধুপুরের জনগণ বনবিভাগ কর্তৃক তথাকথিত উচ্ছেদ নোটিশ মানিনা।
প্রবীণ আদিবাসী নেতা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ তার বক্তব্যে বলেন, বনবিভাগ হওয়ার আগে থেকেই মধুপুর বনে আদিবাসীরা বসবাস করছে সুতরাং আলোচনা ছাড়াই আদিবাসীদের উচ্ছেদ নোটিশ দিয়ে যে নীল নকশা করছে আমরা তার প্রতিবাদ জানাই। অতীতে দেখা গেছে, মধুপুরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বন বিভাগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তবে তারা বন ধ্বংস করে আদিবাসীদের উপর দোষ চাপায়। আদিবাসীরা বন ধ্বংস করে না বরং রক্ষ করে জোর গলায় বলেন তিনি ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ বলেন, পীরেন হত্যার বিচার আমরা পাইনি বরং গড়াঞ্চলের নিরীহ আদিবাসীদের নামে শতশত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। অবিলম্বে পীরেন হত্যার বিচার করতে হবে এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।তিনি আরো বলেন, মধুপুরের অরণ্য জুড়ে আদিবাসীরা বসবাস করে এবং একে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলা হয়। ভোটের সময় আওয়ামী লীগ আদিবাসী মানুষের পাশে ঘেঁষে কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরল আদিবাসীদের ভুলে যায়; প্রতারণা করে বলে সরাসরি অভিযোগ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদক অলিক মৃ’র। মধুপুরের আদিবাসীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান এই ছাত্র নেতা।
গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু) মধুপুর উপজেলা শাখার সভাপতি ইব্রিয় মানখিন বলেন, ‘২০০৪ সালে মধুপুর ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে পীরেন স্নালকে বনবিভাগ ও তাদের দোসরেরা গুলি ছোড়ে হত্যা করে। তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহনের পরও আদিবাসীরা ভূমির অধিকার পেলনা। কবে পাবে? এমন তির্যক প্রশ্ন গাসুর এই নেতার।
গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (জিএসএফ) কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল বলেন, ‘করোনার সময়েও শাল-অরণ্যে বসবাস করা আদিবাসীদের জনসমাগমে এসে প্রতিবাদ মিছিল গণ-অবস্থান নিতে হয়। এই কর্মসূচি শাল অরণ্য রক্ষার আন্দোলন, শত ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে হলেও আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। নিজেদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে মধুপুরে গড় সহ সারা বাংলাদেশে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার বার্তা দেন এই ছাত্রনেতা।
সংরক্ষিত বনভূমির নামে আদিবাসী উচ্ছেদ আতঙ্কের অবসান না করলে আগামী দিনে কঠোর আন্দোলনে নামার হুশিয়ার বার্তা উচ্চারণ করেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি লিংকন দিব্রা।
আবিমা গারো ইয়ুথ এসোসিয়েশন (আজিয়া)র সদস্য সচিব শ্যামল মানখিন বলেন, মধুপুরে আদিবাসীদের ভোট হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামীলীগ সরকার অথচ আদিবাসী বিদ্বষী নানান প্রকল্প বাস্তবয়ন করছে এই সরকারের আমলেই। আওয়ামী লীগ সারাজীবন ক্ষমতাই থাকবেনা। যদি আওয়ামী লীগ এর আমলেই আদিবাসীরা নির্যাতিত হয়, অন্য সরকারের আমলে কিভাবে রক্ষা করবে।
আচিক মিচিক সোসাইটির সভাপতি সুলেখা ম্রং তার বক্তব্যে বলেন, বন বিভাগ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পোশাক পরিধান করে বন রক্ষার নামে মধুপুরের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করতে আসে। কিন্তু আদিবাসীরা আছে বলেই এখনো মধুপুরে বন দেখতে পাওয়া যায়। বন বন বিভাগের হাতে গেলে এইসব বন আর দেখা যাবে না। বন বিভাগ, বন আইন তৈরীর আগে থেকেই মধুপুরে আদিবাসীরা বসবাস করে আসছে। যার প্রমাণ ভুটিয়ার প্রাইমারী স্কুল ও বেরীবাইদের প্রাইমারী স্কুল। ১৯১৫ সালে ভুটিয়াতে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এছাড়াও কোচ আদিবাসীদের পক্ষে সংহতি বক্তব্য রাখেন গৌরাঙ্গ বর্মন, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (টিডব্লিউএ) মধুপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান উইলিয়াম দাজেল , মধুপুর উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সহ অনেকেই।
মানববন্ধন থেকে আগামী ৩১ জানুয়ারি জলছত্র মাঠে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়।
আনারস চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে আদিবাসীরা মিছিল নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে যান এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।